আজও প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে গিয়েছে তাঁর মৃত্যুতে! প্রেমজীবনে বেপরোয়া সিদ্ধান্ত, রহস্যে ঘেরা একসময় টলিউডের সুন্দরী নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরী জীবন

টলিউডের এমন অনেক তারকা আছেন, যাদের প্রতিভা খুব অল্প সময়ের জন্যই লোকের সামনে ধরা পড়েছে। অনেক তারা হারিয়ে গেছে ক্ষনিকের মধ্যেই। তারমধ্যে একটি জ্বলন্ত তারার নাম মহুয়া রায়চৌধুরী।

শহরজুড়ে বিরামহীন বৃষ্টি। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিংহোমের আটতলার ৭২২ নম্বর ঘরে ঝলসানো শরীরে শুয়ে রয়েছেন টলিউডের বেশ পরিচিত নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরী। তবে এটা কোনও সিনেমার দৃশ্য নয়। বাস্তব জীবন। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ এর হয়ে বাংলা ছায়াছবিতে পা রেখেছিলেন অভিনেত্রী। নিজস্বতা বজায় রেখে একটু একটু করে সকলের সামনে নিজেকে তুলে ধরছিলেন। কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য স্থায়ী ছিল না। আগুনে পুড়ে ১১ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অগুনতি মানুষের চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।life story

স্বামী-সন্তান নিয়ে ভরা সংসার ফেলে, অভিনয় জগতে নিজের প্রতিভার এক টুকরো ঝলক দেখিয়ে সকল প্রযোজক-পরিচালক, নির্দেশকদের এক গভীর অনিশ্চয়তায় মধ্যে রেখে চলে গিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রির এই তারা। কাহিনীর সূত্রপাত উত্তর কলকাতার চৌধুরীপাড়া দিয়ে। যেখানে একটি অস্থায়ী স্টেজে উপস্থিত স্বনামধন্য সব শিল্পীরা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র সুচিত্রা সেনের মতো তারকাদের ভিড় জমেছে সেখানে।

তখনই অতিকষ্টে জনৈক নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর ছোট্ট সাত বছরের মেয়ে শিপ্রার নাচ দেখানোর ব্যবস্থা করেন। উদয় শঙ্করের দলে নাচ করেছেন নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী। নামী এডিটরের শাগরেদ হিসেবে কাজ করেছেন। অর্থ, যশের আশায় পাড়ি দিয়েছিলেন বম্বে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। ফিরে এসে নিজের চার বছরের মেয়ে শিপ্রাকে একটু একটু করে নাচে-গানে পারদর্শী করে তুললেন। সেদিন চৌধুরীপাড়ার সেই আসরে ছোট্ট শিপ্রার নাচ মুগ্ধ করল সকল তারকাদের। মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকরাও। তারপর রোজগার শুরু হল সেই পুতুল খেলার বয়স দিয়ে স্টেজে নাচ করে।

life story

এরপর বাবার টলিপাড়ায় যোগাযোগের সুবাদে স্টুডিও পাড়ায় হাজির সেই ছোট্ট শিপ্রা। সেইসময় পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘নয়া মিছিল’ ছবির জন্য খোঁজ চলছে নায়িকার। সেই সময়ে সুখেন দাসের খাঁটি সোনা চিনতে ভুল হয়নি। তবে নির্দেশকদের ওই চরিত্রের জন্য উপযুক্ত মনে হয়নি শিপ্রাকে। স্টুডিও ছেড়ে বেরোতেই পিছু ডাক পড়লো সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত মেকাপম্যান জামাল ভাইয়ের। খবর পাওয়া গেল তরুণ মজুমদারের আগাম ছবির জন্য অল্প বয়সী নতুন মুখ খোঁজা হচ্ছে। ব্যাস!

কনে বউ সেজে সন্ধ্যা রায় ও তরুণ মজুমদারের সামনে হাজির মাত্র ১৩ বছর বয়সি শিপ্রা। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর বউ থেকে প্রেয়সী হবার যাত্রা শুরু এক নতুন নামে। এরপর বাংলা চলচ্চিত্র জগতে শিপ্রার নতুন নাম হল মহুয়া রায়চৌধুরী। ধীরে ধীরে শিশুশিল্পী থেকে সে হয়ে উঠল নায়িকা। ‘দাদার কীর্তি’। তাপস পাল, সঙ্গে মহুয়া রায় চৌধুরী। গিয়েছিলেন ঘাবড়ে। প্রথম প্রথম সকলেরই এমন হয়। সেই ছবিতে মহুয়ার ছোট বোন ছিল দেবশ্রী রায়। অনেকেই তাঁকে চেনে ‘চুমকি’ নামে চেনেন।

life story

এরপর ধীরে ধীরে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নিজের নাম তৈরি করছিলেন তিনি। এরইমধ্যে প্রেমে পড়েছিলেন তিলকের। যিনি তখন স্টেজে গান গান। তাঁদের একসঙ্গে থাকাতে আপত্তি ছিল বাড়ির। তবে কোনও বাঁধাই মানতে নারাজ মহুয়া। সহায় হয়েছিলেন অভিনেত্রী রত্না ঘোষালের। পাশে ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ কুমার। মেয়ের সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই বাবা মেনে নেন নি। তবে শেষমেশ জেদি মেয়ের কাছে হার মানতে হয়েছে।

life story

তিলকদের হেদুয়ার পুরনো বাড়ি। ব্যাঙ্কের চাকুরে। শুরুটা হল ভালোবাসার সঙ্গেই। তিলকের দাদা অলোক চক্রবর্তী দুজনকে নিয়ে প্রযোজনা করলেন ‘আনন্দমেলা’। কিন্তু ছবি চলল না। অন্য পরিচালকদের কাছ থেকে এদিকে ডাক আসছে মহুয়ার। দুজনে একসঙ্গে উঠে এল টালিগঞ্জের বাড়িতে। মাঝ রাতে ভ্রমণ, ফুর্তি সবমিলিয়ে চলছিল জীবন। তারমধ্যে এল ফুটফুটে পুত্রসন্তান। অন্যদিকে বাদশা ছবি দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে তিলকের। সুখেন দাসের ‘প্রতিশোধ’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেন দুজনে। অন্যদিকে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সেই চোখ’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘মাটির স্বর্গ’। এরপর উত্তম কুমারের মৃত্যুতে অসম্পূর্ণ ছবি ‘হার মানিনি’। অন্যদিকে অভিনেত্রীর অকাল প্রয়াণে তাঁর হাতে ছিল ২০টি ছবি।life story

তাঁর শেষ ছবি ‘আশীর্বাদ’। বীরেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত। শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যামেরাবন্দি করলেন অভিনেত্রীর শেষ শট। যেখানে কাঁদতে কাঁদতে ফোনে মহুয়া বলছে, “আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও”। সংশয়, সন্দেহ আজও রয়ে গিয়েছে। এনসি বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট পুলিশ, সিআইডি এবং এএন দুবে, ইন্সপেক্টর মৃত্যুকালীন জবান বন্দি নিয়েছিলেন। সাক্ষী হিসেবে সই করেন দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী এবং সিস্টার ঊষা। উপস্থিত ছিলেন রত্না ঘোষাল। বাড়িতে দুজন পরিচারক কিন্তু তবুও নিজের খাবার বানাতে কেন গেল মহুয়া? অন্যদিকে স্বামী তিলক দাবি করেন, ডিনারের পর দুর্ঘটনা ঘটেছে। মহুয়ার অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনাটি যদি ঘটে থাকে, তাহলে বাড়িতে চারজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও কি করে এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে ছিল তা? স্টোভ বার্স্টের তত্ত্ব বারবার পরিবারের তরফ থেকে খাড়া করা হচ্ছিল। এদিকে পিঠে, শরীরের বহু জায়গায় রয়েছে কালশিটে দাগ। এরকমই হাজারো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও।life story

প্রায় ৭০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল তাঁর। এদিকে রান্নাঘর একরকম অক্ষতই রয়েছে। কিন্তু পোড়া শোবার ঘরের লেপ, তোষক, বালিশ। বিছানায় গন্ধ কেরোসিনের। কী ভাবে? কী করে? এর উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মাধবী চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, মহুয়ার মৃত্যুর পরে তাঁর বাবা স্মরণসভার আয়োজন করার প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে এসেছিলেন। তবে মৃত্যুর যথোচিত কারণ না জানা পর্যন্ত এই ধরনের কোনও সভায় অংশগ্রহণ করবেন না বলে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী। এর ১০ বছর পর প্রদেশ মহিলা কংগ্রেস আয়োজিত “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” উপলক্ষে মহুয়া রায়চৌধুরীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ তোলেন মাধবী চক্রবর্তী। এখনও অনেকের কাছেই অজানা সেই বৃষ্টি ভেজা কালো রাতের কাহিনী।life story

Back to top button